স্লাইড শো

শামসুল বারী উৎপল

- Advertisement -

সেদিন ছিল শুক্কুরবার। অতি জরুরী সাধারণ সভা। আকাশে সুপার মুন জ্বলজ্বল করছে তারপরও জ্বলছে মশাল। দাউ দাউ। সভার সভ‍্যরা চুপ-চাপ, ভেতরে চাপা ক্ষোভ, মশালের মতই দাউ দাউ। গর্জে উঠলো বাঘ সহ-সভাপতি, ‘ এটা কোন কথা হলো, না না এভাবে চলবে না, চলতে পারে না’। খেকিয়ে উঠল কোষাধ্যক্ষ, ‘সবকিছু একটা হিসাবের মধ্যে থাকা উচিত।’ কোষাধ্যক্ষ সাহেবের মুখ দিয়ে দূর্গন্ধি-লালা বের হতে থাকে, ‘এভাবে চলতে পারে না’।

উত্তেজনায় সংসদীয় উপ-কমিটির অন‍্যতম সদস্য চিৎকার দিয়ে এক খাবলা থুথু ফেলে প্রচন্ড ঘৃণায়, ‘এই থুথু মানব জাতির বিরুদ্ধে ওরা মরুক, ওরা ধ্বংস হোক’। শ্লোগান উঠল চারিদিকে, ‘ আসুন এবার যুদ্ধে যাই, মানব জাতির ধ্বংস চাই’। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে বাতাস, বহুবছর শীত নিদ্রায় ছিল যে ব‍্যাঙটি সেও আড়মোড়া ভেঙে বেরিয়ে এলো। মাননীয় সাধারণ সম্পাদক সাহেব মাইক্রোফোন হাতে নিলেন তারপর পয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকা হয়ে বললেন, ‘ আপনারা স্লাইড শো দেখেন’। অত‍্যাধুনিক স্ক্রিনে শুরু হলো স্লাইড শো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক দৃশ‍্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিরোসিমার বহ্নুৎসব, পানিপথের হত‍্যাযজ্ঞ, রক্তাক্ত বলকান, পলাশির যুদ্ধ একে একে আসতে থাকে হত‍্যা ধর্ষণের মৃত্যুপুরি একাত্তরের বাংলাদেশের নির্মম চিত্র, ইরাক ইরানের যুদ্ধ, বিধ্বস্ত গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার হাজার ছবি, বিভৎস মানুষের মুখ, রক্তাক্ত সিরিয়া, সুস্থ মাথায় মানুষ হত্যা। ডুকরে কেঁদে ওঠে বৃদ্ধ সভাপতি, কাঁদতে থাকে সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, রাগি প্রচার সম্পাদকসহ খিটখিটে মেজাজের দপ্তর সম্পাদকসহ সবাই। চোখের জল ক্রমাগত চোখ থেকে বুকে টপ-টপ পড়তে থাকে আর তা হৃদয়ে আঘাত করে আনবিক শক্তি হয়ে। কেউ একজন চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, ‘হে আল্লাহ, বিচার কর, তুমি বিচার কর, আমরা মানুষ জাতির ধ্বংস চাই।’
স্লাইড শো চলছে … চলছে…। কেউ একজন আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ে, ‘বন্ধ কর এই স্লাইড শো, বন্ধ কর।’ কিন্তু, অত‍্যাধুনিক প্রযুক্তির স্লাইড শো বন্ধ হয় না, চলতে থাকে, চলতেই থাকে। অত‍্যন্ত শক্ত মনের সাধারণ সম্পাদক শেয়াল পকেটের রুমাল দিয়ে চোখ মোছে, ‘প্রিয় সারথী, প্রিয় পশুপাখি বন্ধুরা, আমাদের আজকের মিটিংয়ের একমাত্র বিষয় মানুষের পশুত্ব।’ উঠে দাঁড়ালো বাঘ, কিঞ্চিৎ শোরগোল, ‘প্রিয় সদস্য, সম্মানিত সভাপতি, আমি অত‍্যন্ত শক্তিশালী প্রাণী, কিন্তু কই আমি তো আমার ভাইয়ের মাংশ খাইনা, অত‍্যন্ত ক্ষুধা পেলে বড়জোর হরিনের মাংশ…’। দূরে বসা ছিলো হরিন, সে রিনরিনে গলায় বলল, ‘কেন আমাকেই খেতে হবে কেন, ছাগল-টাগল কি নেই আফ্রিকার বনে!’ ভ‍্যা ভ‍্যা করে উঠলো ছাগল, ‘কেন গরু খেলেই তো পারে’। গরু পদাধিকার বলে ছাগলের উপরে দপ্তর সম্পাদক, ভাগ‍্য ভালো সে শুনতে পায়নি দাপ্তরিক কাজে ব‍্যস্ত থাকায়, ঘোৎ ঘোৎ করে বলল, ‘ খাদ‍্যাভ‍্যাস পরিবর্তন করলে কী হয়, যত্তোসব’।

সহ-সভাপতি গন্ডার গম্ভীর গলায় বলল,’আমাদের আজকের আলোচ‍্য বিষয় একটিই তা হ’ল মানুষের পশুত্ব।’ কুকুর শেয়ালের কানে কানে এসে বলল “সেক্রেটারী সাহেব আমার ঘ্রাণ শক্তি বলছে এফ আই এর এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আমাদের ফলো করছে” হাতি শুনেই লাফিয়ে উঠলো, ‘কোথায় মানুষের বাচ্চা মানুষ, এক্কেবারে পায়ের নিচে ফেলে…’। পাশের নদী থেকে উকি দিল কুমির, ‘সব শালা মানুষের বাচ্চারে আমি খাবো’। মাছগুলো নেচে উঠলো, ‘বেশ হবে পৃথিবী থেকে মানুষগুলো মরে গেলে, কি মজা হা হা।’

বিজ্ঞানী শিম্পাক্তি তার পকেট থেকে বের করলো একটা ছোট যন্ত্র, ‘মানুষ চুরি করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে শেষমেষ আর কিছু চুরি করার না পেয়ে আমাদের হাজার বছরের বৈশিষ্ট্যই চুরি করে নিয়ে গেছে।’ সিংহ, মাননীয় সভাপতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, ‘এভাবে চলতে দেয়া যায় না, আমরা ওদেরকে শেষ করে ফেলবো।’ ইনভেষ্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের এজেন্ট ময়ুর গোপনে সব কিছু ভিডিও করছিল। কুকুর কিভাবে যেন ওর দিকে তাকাচ্ছিল, প্রেম নাকি সন্দেহ। ছোট্ট বেবুন সাধারণ সদস্য সেও চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘আমরা মানুষের বিচার চাই, আমরা ওদের ধ্বংস চাই’। সুপার মুন সেদিন, অতি সাধারণ জনগণ চাঁদ স্বাক্ষী হয়ে রইল সে মিটি মিটি হাসলো। একটা গরিলা উঠে দাঁড়ালো, ‘বন্ধুরা আসুন আর দেরি নয় সবাই মিলে বের হই রাজপথে, জনপদ দখল করি মানুষদেরকে ছিড়ে খুড়ে খাই। ওদের অসভ্য-সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেলি।’ হাসলো শিম্পাক্তি, ‘আরে পাগল ওদের সভ্যতা ওরাই ধ্বংশ করছে, ওদের অগ্রযাত্রা ওরাই বাধাগ্রস্থ করছে, ওরাই ওদের জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে!’ বোকা দৃষ্টিতে তাকালো বুনোষাড়, ‘কিভাবে?’ শেয়াল এবার খুক খুক কাসলো ‘শিম্পাক্তি কাকা তুমি তো একদম ঠিক, হ্যা হ্যা… ‘। কুনোব্যাং, বরাবরই ওর বুদ্ধি জ্ঞান একটু কম তাই গলা বাড়িয়ে বললো ‘আচ্ছা পৃথিবীর যে রাজা ঐ যে, কে যেন, ও হ্যা বাবা ওমামা, উনাকে একটু বুঝিয়ে বললে হয় না, সে জাতি সংঘের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা করতে পারে’। হাসলো সাদা কবুতর ‘আরে গাধা জাতি সংঘ কি সোল প্রপ্রাইটরশীপ।’ পাশে বসে ছিল গাধা চোখ কপালে তুলে সে হাত উঁচু করল কিছু বলবে বলে। খেঁকিয়ে উঠলো হায়েনা, ‘ভাই তোমরা থামবা, শুধু আমাকে দায়িত্ব দাও আমি আমার হায়েনা বাহিনী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি।’ শিম্পাক্তি উদ্ধত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা থাম, আমাদের বৈশিষ্ট্য এখন ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে তার মানে মানুষ চায় আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করতে আমি দীর্ঘ দিন গবেষণা করে একধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব আবিষ্কার করেছি যার স্বভাবই হ’ল মানুষের শরীরে ঢুকে যাওয়া আর তারপর বংশ বিস্তার করা’। হাউ মাউ করে উঠলো বানর, ‘তোমার এসব ফালতু কথা রাখোতো পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর জাতি এখন মানুষ জাতি ওদেরকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমাদের শান্তি নাই।’ শিম্পাক্তি ঠান্ডা মাথায় ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আমার হাতে যে যন্ত্র দেখছো এটা আমার অনেক গবেষণার ফল। এটার কাজ হ’ল ঐ যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব, যার স্বভাবই হ’ল মানুষের শরীরে প্রবেশ করা, সেই অনুজীবের ভিতরে আমাদের অর্থাৎ পশুদের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া, হা হা হেসে উঠলো লম্বা গলার উট, ‘হে হে বুঝে ফেলছি এখন আমাদের কাজ হ’ল ঐ অনুজীবের ভিতর পশুদের জিন ঢুকিয়ে তা লোকালয়ে ছেড়ে দেয়া হা হা হা হা, কিল্লা ফতে’। গুই সাপ অনেক্ষণ থেমে থেমে বলল, ‘ওরা তো আমাদের স্বভাবই গ্রহণ করার প্রাণপন চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত চিন্তা করতো সেই দৃশ্যটা ধীরে ধীরে সমস্ত পৃথিবী মানুষ-শূন‍্য হয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো পরিণত হচ্ছে বাঘ, সিংহ, হায়েনা, সাপ বিচ্ছুতে, চারিদিকে শুধু পশু আর পশু কি মজা হাহাহ্যা’।

কুকুর আবার সাধারণ সম্পাদক সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আমার ঘ্রাণ শক্তি বলছে কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা মানুষ অস্ত্র হাতে আমাদের চারপাশে ঘুর ঘুর করছে’। শেয়াল এক মিনিট চুপ থেকে সভাপতির কানে কানে কী যেন বলল, ঠিক বোঝা গেল না, তারপরই কুকুর ছুটে বেরিয়ে গেল। সাধারণ সম্পাদক ল্যাপটপে নোট করলো গুগলে সার্স দিল তারপর এক বিন্দুতে থামলো। কুকুরের ঘেউ ঘেউ, বানরের ছুটাছুটি হাতির ভাংচুর তারপর শিম্পাক্তি, ‘আমার এখন একজন গিনিপিগ- মানুষ দরকার, এক্সপেরিমেন্টের জন্যে’। বিশাল স্ক্রিনের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুই মানুষ হাত পা বাঁধা। একজনের মুখ কালো কাপড়ে বাধা, ভারি অস্ত্রে সজ্জিত অন্যজনের শরীরে ক্যামেরা, মোবাইল, মিনি কম্পিউটারসহ আরো কত কি, একজন ধ্বংসের জন‍্যে আরেকজন শান্তির পক্ষে।

শিম্পাক্তির আবিষ্কৃত যন্ত্রের কার্যকারিতা শতভাগ প্রমাণিত হওয়ায় একজন সাধারণ সদস্য প্রস্তাব করল শিম্পাক্তিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত পুরষ্কার দেওয়ার জন‍্যে, কিন্তু আলফ্রেড নোবেল যেহেতু মানুষের উপকারের জন‍্যে ডিনামাইড আবিষ্কার করেছিল তাই সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হ’ল, বাংলাদেশে একজন শান্তির পক্ষের লেখক আছেন, যিনি সকল সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিপক্ষে, তাঁর নামেই নতুন একটি পুরষ্কার ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেয়া হ’ল শিম্পাক্তিকে।

শিম্পাক্তি তার গবেষণাগারে মহাব্যস্ত নুতন আরেকটা অনুজীব উদ্ভাবনে যে অনুজীব মানুষের জিন নিয়ে পশুর শরীরে প্রতিস্থাপন করবে। চলছে গবেষণা, প্রাণান্ত প্রচেষ্টা, একদিন কি সত্যিই পশুগুলো সব মানুষে পরিণত হবে, আর মানুষগুলো পশুতে!

 

- Advertisement -

পছন্দের অন্যান্য খবর

- Advertisement -

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.